ক্ষুদ্রাকার হলেও ইঁদুর নামক প্রাণীটির ক্ষতিকর দিকটি বিশাল। আমাদের দেশে প্রতি বছরই এই প্রাণীটির নিধনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ অভিযান চালানো হয়, যাকে আমরা ইঁদুর নিধন অভিযান নামে আখ্যায়িত করি। এই অতিতুচ্ছ প্রাণীটি দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্তরাই প্রাণীটির নিধনের গুরুত্ব টের পান। এদের ক্ষতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত।
ইঁদুরের সামনে একজোড়া করে খুব তীক্ষè দাঁত আছে, যা জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। আর এই সদাবর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ।
ইঁদুর যে শুধু ফসলেরই ক্ষতি করে তা নয়। বইখাতা, কাপড়, আসবাবপত্র, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেটে নষ্ট করে। এরা মাঠের দানাজাতীয়, শাকসবজি, মূলজাতীয়, ফলজাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবার গুদাম ঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগজীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। এ ছাড়া এরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ-নালা গর্ত করে নষ্ট করে, অনেক সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত ঘটায়। এজন্য ইঁদুর দমন অত্যন্ত জরুরি।
ইঁদুরের ক্ষতিকারক প্রজাতি : বাংলাদেশে প্রায় ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকারক ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। তিনটি ইঁদুরের প্রজাতি দশমিনা বীজ বর্ধন খামারে পাওয়া গেছে। প্রজাতিগুলো হচ্ছে-
* মাঠের বড় কালো ইঁদুর(Bandicotabengalensis)
* মাঠের কালো ইঁদুর (Bandicotaindica)
* গেছো ইঁদুর (Rattusrattus)
মাঠের কালো ইঁদুর বাংলাদেশে কৃষি ফসল, গুদাম, গ্রাম ও শহর এলাকাসহ সর্বত্র একটি প্রধান ক্ষতিকারক বালাই। সেন্টমার্টিন দ্বীপে এদের সংখ্যাই বেশি হলেও ঘরের ইঁদুর ও গেছো ইঁদুরের বাংলাদেশের সর্বত্র উপস্থিতি রয়েছে।।
ইঁদুরের আচরণ বা স্বভাব : এদের দুই জোড়া অনবরত বৃদ্ধি কর্তন দাঁতগুলোর আকার স্বাভাবিক রাখার জন্য এরা সবসময় কাটাকাটি করতে হয়।
* যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপখাইয়ে চলতে ও বংশবিস্তার করতে পারে;
* কিছু প্রজাতি আরোহন এবং সাঁতারে পটু;
* ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল;
* এরা খাদ্যের স্বাদ বুঝতে পারে;
* এরা রঙ নির্ণয় করতে পারে না;
* ইঁদুর সাধারণত রাতে চলাচল করে এবং দিনে লুকিয়ে থাকে;
* নতুন জিনিসের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। যেমন- ফাঁদ বা বিষটোপের প্রতি লাজুকতা।
বর্ষা মৌসুমে নিম্নভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ ও পুরনো স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে সেচনালা, বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। সেচনালার (ইৎবধশরহম ড়ভ পধহধষ) মধ্য দিয়ে যখন পানি প্রবাহিত হয় তখন অতি মাত্রায় চুঁয়ানোর (ঝববঢ়ধমব) জন্য সেচনালায় ফাটল দেখা দেয়। আর ওই ফুটো/ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করে সেচনালা, বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার সেচ যন্ত্রের কন্ট্রোল বক্সের ক্ষতি করে।
পানির একমাত্র অংশ কার্যকরিভাবে ব্যবহার করা হয়। বাকি পানি সেচিত ক্ষেত্রগুলোতে ফসলের জন্য হারানো হয়। অর্থাৎ কোনো উৎস (নদী, ভালো) থেকে নেওয়া সম্ভব পানি উদ্ভিদের মূলজোন পৌঁছায় না। পানির অংশ খালের মাধ্যমে এবং ক্ষেতের মধ্যে পরিবহনের সময় হারিয়ে যায়। অবশিষ্ট অংশ রুটজোন মধ্যে সংরক্ষিত এবং অবশেষে গাছপালা দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
যে কারণে ক্ষেতের পানির অপচয় হয় তার মধ্যে খাল/বাঁধে
ইঁদুরের সারি গর্ত অন্যতম।
প্রতিকার :
ি সেচনালার আকৃতি অপরিবর্তিত রেখে ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণী গর্ত অথবা বসে যাওয়া (উবঢ়ৎবংংরড়হ) বা ভেঙে যাওয়া সেচনালা বাঁশের খুঁটি পুঁতে চিহ্নিত করতে হবে। গর্ত, বসে যাওয়া ও ভাঙা স্থানসমূহ এঁটেল মাটি দিয়ে ভর্তি করে তা ভালোভাবে পিটিয়ে (ঈড়সঢ়ধপঃ) তলানি পরিষ্কার, ভাঙা সেচ-নালা মেরামত করতে হবে।
ি আবার ভূগর্ভস্থ সেচনালা বা বারিড পাইপলাইনের মাধ্যমে আমরা ইঁদুর বা অন্যকোনো প্রাণীর দ্বারা সেচনালার ক্ষতি এড়াতে পারি।
ি সাধারণত দুইভাবে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে।
* রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
* পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন
* রাসায়নিক পদ্ধতি : বিভিন্ন ধরনের বিষ ব্যবহার করে ইঁদুর দমনকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন বলে। দুই ধরনের বিষ সাধারণত পাওয়া যায়। তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ এবং দীর্ঘ স্থায়ী বিষ।
১. তীব্র বিষ : জিঙ্ক ফসফাইডের বিষটোপ প্রস্তুত করার জন্য প্রতি ৪০ ভাগ আটা ময়দার সাথে ১ ভাগ বিষ ও ৩ ভাগ গুড় এবং পরিমাণ মতো তেল মিশিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে জায়গায় জায়গায় রেখে দিতে হবে। বিষটোপ ব্যবহার করার আগে কিছুদূর অন্তর অন্তর ৩ থেকে ৪ দিন বিষ ছাড়া টোপ সন্ধ্যার আগে রেখে দিতে হবে। জিংক ফসফাইড খাবার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায়। এই ফাঁকা বিষটোপ কয়েক দিন খাওয়ার পরে সেইসব জায়গায় বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র বিষ টোপ ব্যবহারে কিছু কিছু অসুবিধা আছে তাহলে জিঙ্ক ফসফাইড দ্বারা তৈরি করা বিষটোপ ইঁদুর পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার আগে অল্প কিছুটা মুখে দিয়ে পরখ করেও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু মরে না।
২. দীর্ঘ স্থায়ী বিষ : দীর্ঘ স্থায়ী বিষ হচ্ছে রেকুমিন, ব্রোডইফেকুন। দীর্ঘ স্থায়ী বিষ দিয়ে তৈরিকৃত বিষটোপ ইঁদুর খাওয়ার পর ইঁদুরের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পায়,
ফলে ইঁদুরের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে এবং ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। এ ধরনের বিষ খাওয়ার
সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায় না।
৩. বিষ বাষ্প প্রয়োগ : গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে বিষটোপ প্রয়োগ করে গর্তের ইঁদুর মারা খুবই কার্যকর। মাঠ ফসলের ক্ষেত্রে থোড় থেকে পাকা অবস্থা পর্যন্ত গ্যাস বড়িগুলো হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড।
পরিবেশ সম্মতভাবে দমন : পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন হলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে অর্থাৎ কোনো রকম বিষ ব্যবহার না করে ইঁদুর দমন। যেমন-
১. ফাঁদপাতা : বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন- বাঁশ, কাঠের, টিন ও লোহার তার দ্বারা তৈরি ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা :
ক. ইঁদুর নোংরা স্থান পছন্দ করে বিধায় বাড়িঘর, ক্ষেতখামার, পুকুরপাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীরপাড় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে।
খ. খাদ্যগুদাম এবং খড়ের গাদা মাটির সাথে তৈরি না করে।
গ. বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাড়ি বা গুদাম ঘরে ইঁদুর যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. প্রাণী সংরক্ষণ : পেচা, গুঁইসাপ, বেজি, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীগুলোকে (ইঁদুর যাদের প্রধান খাদ্য) সংরক্ষণ করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখতে ইঁদুরের সম্পূর্ণ নিধন ঠিক নয়। কাজেই, সেচ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনতে সেচনালাসমূহ, বাঁধসমূহ রক্ষণাবেক্ষণে ইঁদুরের ভারসাম্যপূর্ণ দমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এ কাজটি আমাদের খুবই সুচারুভাবে করতে হবে।
ইফফাত আরা
সহকারী প্রধান প্রকৌশলী (মিশু), বিএডিসি, কৃষি ভবন, ঢাকা, মোবা: ০১৭১৭৮৫১৫৭৯, ই-মেইল :ace1milisu@gmail.com